মাতৃভাষায় শিক্ষাদান

মাতৃভাষায় শিক্ষাদান (Teaching Through Mother Language)

 

“হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,.
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ।………….
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর
আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই,
যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম
কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥”

ভূমিকা:

আমাদের মননজাতে যাবতীয় চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন ঘটে ভাষার আঁধারের বিশেষত মাতৃভাষার মাধ্যমে বাক্যালাপের তৃপ্তি ভাবনাতীত। তাই শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রেও মাতৃভাষার অবদান অনস্বীকার্য। মাতৃভাষার শিক্ষা লাভ শিক্ষাদানের যে সারল্য স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হয় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ফলত, শিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যমে যে মাতৃভাষা তা বলাই বাহুল্য।

প্রাচীনকালের শিক্ষার মাধ্যম:

প্রাচীনকালের শিক্ষার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা। ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয়-বৈশ্য সমাজের মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে ভারতে ইংরেজ শাসনের প্রসার ঘটলেও ইংরেজ জাতির স্বার্থেই এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে।

ইংরেজি ভাষার আধিপত্য:

এককালে ইংরেজ শাসকগণ কিছু কেরানি তৈরীর জন্য যে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রবর্তন ঘটান আজ তারে পদতলে দলিত সমগ্র ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা। ভারতীয় সংবিধান চালু হওয়ার পর ইংরেজি ভাষা এদেশে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করলে শিক্ষার মাধ্যম রুপে ও ইংরেজি ভাষার প্রসার ঘটে।

মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা:

বিদেশী ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে যে ভাষার ব্যবধান তৈরি হয় তা মাতৃভাষার প্রয়োগে অতি সহজেই মুছে যেতে পারে। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রধান মন্ত্র ” Greatest good of the greatest number” । তাই জাতির ভাষা কে বর্জন করে নয় জাতীয় ভাবকে ধারণ করেই সাধারণ থেকে অতি সাধারণ জ্ঞানের সন্ধান প্রদান সম্ভব হবে। সুতরাং মাতৃভাষা জাগরণ ঘটিয়েই আপামর জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হতে পারে।

ভাষা প্রয়োগ বিষয়ে মতানৈক্য:

শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রয়োগ এর সার্থকতা বিচার প্রসঙ্গে শিক্ষিত মহলে মতানৈক্য বর্তমান। স্বদেশী ভাবনায় ভাবিত সকল ব্যক্তি আশা করেছিলেন পরাধীনতার অবসানে এদেশে স্বদেশী ভাষার প্রসার ঘটবে। কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতানরাগীর দল আন্তর্জাতিক জ্ঞান ভান্ডার উন্মোচিত করতে ইংরেজি ভাষায় কে সর্বান্তকরণে ধারণ করে থাকল। অবশ্য গান্ধীজীর মত রাজনীতিঞ্জ, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নত বৈজ্ঞানিক, রবীন্দ্রনাথ,অক্ষয় কুমার, রামেন্দ্রসুন্দর প্রমূখ সাহিত্যিক সর্বদা বাংলা তথা মাতৃভাষাই পক্ষাবলম্বন করে গেছেন কারণ তারা নিজেরাও মাতৃভাষার মাধ্যমে স্ব-স্ব সফল হয়েছেন।

বিদেশি ভাষা শিক্ষার কুপ্রভাব:

বিদেশী ভাষা শিক্ষাদানের এই যুগের ছাত্র মহল ভাষায় পুনর্দখলের অভাবে সাহিত্যকীর্তি কিংবা কাব্যকলা রসভোগ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। পরীক্ষা নামক বইটি তারা মুখস্থ বিদ্যার দ্বারা পার হয়ে যায়। যাতে তাদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হয় না, শিক্ষার সঙ্গে আত্মাও প্রাণের সম্বন্ধিত হতে পারেনা।

অন্যান্য দেশে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উদাহরণ:

জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি উন্নত দেশগুলি যারা বিজ্ঞানের উপর প্রযুক্তির দিক থেকে প্রভূতমাত্রায় তাদের প্রত্যেকের শিক্ষাদানের উপজীব্য ভাষা তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা। বাংলাদেশের-এর অন্যথা ঘটেনি। বর্তমান বিশ্বে ভারত সহ কতিপয় কিছু দেশেই ইংরেজি ভাষার আধিপত্য বজায় রয়েছে নতুন অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয়।

উপসংহার:

শিক্ষা ব্যবস্থা বিদেশী প্রভাব দেশের স্বাধীন চেতনাও স্বজাত্যবোধ যে শুধু আঘাত করে তা-নয় দেশের উন্নয়নে বাধা দেয়। তাই এদেশের মানুষকে একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক চেতনা ও জাতীয় বোধের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এবং এই দেশকে সম্পূর্ণরূপে পরাধীনতার শৃংখল মুক্ত করতে মাতৃভাষায় একমাত্র অবলম্বন। মাতৃভাষাকে সম্মান প্রদান করলেই আমরা ফিরে পাবো আমাদের হারানো মর্যাদা। আমরা সকলে যেন গর্বের সঙ্গে বলতে পারি –

“মোদের  গরব, মোদের  আশা,
আমরি  বাংলা ভাষা !
মাগো তোমার কোলে , তোমার বোলে , কতই শান্তি ভালবাসা !
মাগো তোমার কোলে , তোমার বোলে , কতই শান্তি ভালবাসা  !
আমরি  বাংলা ভাষা !
 মোদের গরব, মােদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা।”

 


সমাপ্ত


আরো পড়ুন 

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Scroll to Top