মহাশ্বেতা দেবী (Mahasweta Devi)

“আমি মৃত্যুর চেয়ে বড় এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে ” |
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূমিকা:

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত প্রতিভাধর লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী চলে গেলে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ৷ শুধু সাহিত্য জগতে নয় ,তার বিচরণক্ষেত্র মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে, পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার নিরলস প্রচেষ্টায়, এমনকি বিপন্ন পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগেও তিনি ছিলেন অগ্রণী ৷ এমনই বিচিত্র কর্মময় জীবনের কর্তৃ মহেশ্বেতা দেবী সেরা বাঙালির একজন ৷

শৈশব ও বেড়ে ওঠা :

কল্লোল যুগের কবি মণীশ ঘটক ও সাহিত্যপ্রেমী ধরিত্রী দেবীর কৃতি এই সন্তানের জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় ৷ সেখানেই কিছুদিন স্কুল জীবন কাটানোর পর পরিবারের সঙ্গে এপার বাংলায় চলে আসেন ৷ এরপর যথাক্রমে শান্তি নিকেতন স্কুল ও বেলতলা স্কুলে পড়াশোনা করেন ৷ আশুতোষ কলেজ থেকে আই এ পাস করার পর বিশ্বভারতী থেকে ইংরেজিতে সাম্মানিক সহ স্নাতক হন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন ৷ বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ৷ তার একমাত্র সন্তান কবি ,কথাসাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য্য ৷

কর্মজীবন:

পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশনের প্রাতঃবিভাগের শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন ৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক রূপে স্থায়ী হন ৷ একই সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন মানবধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ৷ ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিজেকে পুরোপুরি সাহিত্য রচনা ও সমাজসেবায় নিযুক্ত করেছেন ৷ তিনি আমৃত্যু এর সঙ্গেই যুক্ত থেকেছেন ৷

সাহিত্যজীবন:

রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থটি নিয়ে ‘রংমশাল’ প্রত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটিই মহেশ্বেতা দেবীর প্রথম মুদ্রিত লেখা ৷ সারাজীবন অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ রচনা করেছেন ৷ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে ‘স্তন্যদায়িনী ও অন্যান্য গল্প’, ‘দ্রৌপদী’, ‘শালগিরার ডাকে’, ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘বাসাইটুডু’, ‘আসামি’,’নঢী’, ‘মধুর মধুর’, ‘তিমির লগন’, ‘আঁধার মানিক’ ,’স্বাহা’, ‘সুভগা বসন্ত’, ‘সিধু কানুর ডাকে’, ‘আগুন জ্বলেছিল’, ‘অগ্নিগর্ভ’, ‘বেহুলা’, ‘পাঁকাল’, ‘কৃষ্ণাদ্বাদশীর’, ‘ঘাতক’, ‘বীরসা মুন্ডা ‘, ‘এককড়ি সাধ’, ‘এতোয়া মুন্ডার যুদ্ধ’ প্রভূতি নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসটি জনমানসে গভীর রেখাপাত করেছে ৷ তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতে মিশে রয়েছে বাস্তবের রুক্ষ মাটির স্পর্শ কাল্পনিক রোমান্টিকতার ঘ্রাণ সেখানে অনুপস্থিত ৷ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনদর্শনই প্রতিফলিত হয়েছে তার সাহিত্যক্ষেত্রে ৷

পুরস্কার ও সম্মান:

১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সাহিত্য আকাদেমি ‘, ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মশ্রী’, ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে’ জ্ঞানপীঠ’,১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে রামন ম্যাগসাই সাই’,২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মবিভূষণ’,২০০৭ খ্রিস্টাব্দে সার্ক সাহিত্য সম্মান,’ ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গবিভূষণ’, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ‘হল অফ ফেম’ প্রভৃতি নানাবিধ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি ৷ এছাড়াও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ‘লীলা পুরস্কার’, ‘শরৎচন্দ্র স্মৃতিপদক’,’ ভুবন মোহিনী পদক’,’ জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, প্রভৃতিও লাভ করেন ৷

উপসংহার:

মহাশ্বেতা দেবী লেখার বৈশিষ্ট্য ছিল প্রত্যক্ষ জীবন উপলব্ধি পূর্ণ ;শহরের ঠাণ্ডা ঘরে বসে কল্পনার ডানা মেলে তিনি শখের সাহিত্য সৃষ্টি করেননি ৷ অতি সাধারন, অবহেলিত মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ ৷ তাঁর মুখ ও মুখোশের রূপ ছিল একই৷ তাঁর মৃত্যুতে(২৮-৭-২০১৬) সামাজিক আন্দোলন ও ব্যতিক্রমী সাহিত্য ঘরানায় এক বড় শূন্যস্থান সৃষ্টি হল ৷

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Scroll to Top