বিজ্ঞান অভিশাপ, না আশীর্বাদ/ বিজ্ঞানের সদ্ ব্যবহার ও অপব্যবহার

ভূমিকা

যে বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের সম্পর্ক,য়ার সাহায্য ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত ও চলতে পারি না, হঠাৎ তাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাওয়া কতখানি যুক্তিসংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা, বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ,এ প্রশ্ন তোলা মানেই বিজ্ঞানের কল‍্যাণ শক্তি সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হওয়া।

বিজ্ঞানের গতি- প্রকৃতিতে উদ্বেগ

সচরাচর বিজ্ঞানের আশীর্বাদ কে আমরা দেখি। বিজ্ঞানের কল্যাণ শক্তির বৈভব প্রতিনিয়ত আমাদের চোখ ঝলসে দেয়।বিজ্ঞান আজ কি না করছে। যানবাহন, যোগাযোগ,আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, আমাদের উপকরণ, সর্বত্র বিজ্ঞানের প্রভাব। বিজ্ঞান দূরকে নিকট করছে, নিত্য নতুন নতুন রহস্যের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়ে মানুষের জ্ঞানের ভান্ডার কে সমৃদ্ধ করছে। কিন্তু বিজ্ঞানবিদ‍্যার সাম্প্রতিক কিছু গতি প্রকৃতি দেখে মানুষ আজ উদ্বিগ্ন। এমনকি বিজ্ঞানের কাছ থেকে প্রাপ্তির নামে যা কিছু আছে চোখে পড়ছে, মানুষ তাদেরও অনেক কিছুর ওপরেই আর আস্থা রাখতে পারছে না ।

পরমাণু -শক্তির ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা

সাম্প্রতিক বিজ্ঞান বিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরমাণু বিজ্ঞান। পরমাণু শক্তি কে কল্যাণ কর্মে লাগানো যায়, আবার ধ্বংসের উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা চলে‌। আশঙ্কার কথা, পরমাণু বোমা এবং ক্ষেপণাস্ত্র গড়ার কাজে মানুষ সম্প্রতি যে আগ্রহ দেখিয়েছে তা শেষোক্ত উদ্দেশ‍্যেরই পরিপোষক। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করেছে। এক একটি পরমাণু বোমার মধ্যে ধ্বংসের যে বিপুল ক্ষমতা লুকিয়ে আছে, বারুদ আবিষ্কৃত হবার পর থেকে সবগুলোর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ একত্র জুড়লেও তার সমান হবে না। অতএব অনুমান করা যেতে পারে, ওদের মধ্যে গোটা পৃথিবীর ধ্বংস বিদ্যমান। ওদের কয়েকটিকে কাজে লাগালে ও কয়েক কোটি মানুষ ধ্বংস করা যাবে। আর কাজে লাগাবার ব্যবস্থাটা যদি ঘটা করে হয় তা পৃথিবী জোড়া বিরাট সভ্যতা মুছে যেতে সময় লাগবে না মোটেই।

হিরোশিমা ও নাগাসাকির মারণ যজ্ঞ

পরমাণু বোমা প্রথম ফেলা হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই আগস্ট জাপানের হিরোসিমায়। যে বোমাটির ক্ষমতা ছিল কুড়ি হাজার টন টি.এন.টি.-র সমান। টি.এন.টি .বা ট্রাইনাইট্রোটলুইন নামক পদার্থটি তার মারাত্মক বিস্ফোরক ক্ষমতার জন্যে বিজ্ঞানী মহলে সুবিদিত। শুধুমাত্র একটি পরমাণু বোমার আঘাতে হিরোসিমার ৭৮ হাজার নর-নারীর মৃত্যু হয় এবং আহত হয় ৪৮ হাজার। নাগাসাকিতে হত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ,২৭ হাজার ও ৪১হাজার। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বোমা বর্ষণের মুহূর্তে সর্বগ্রাসী আগুনের ঝড় হিরোসিমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং দীর্ঘ 6 ঘণ্টা ধরে শহড়টির উপর তার তান্ডব চলে।এই তাণ্ডব শেষ হলে দেখা যায় হিরোসিমার ১২ কিলোমিটার অংশ জ্বলে ছাই হয়ে গেছে এবং কর্মব্যস্ত অতি সুন্দর এক মহানগরী মহাশ্মশানের বিভীষিকা নিয়ে হাকার করছে।

পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার

উপরের এই বর্ণনা থেকে পরমাণু বোমার ভয়াবহ ক্ষমতা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করা চলে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে হিরোসিমা ও নাগাসাকির উপর যে দুটি বোমা বিদীর্ণ হয়েছিল, তাদের শক্তি পরিমাপক ছিল ‘কিলোটন’।এখন তার চেয়ে আর ও অনেক বেশি শক্তিশালী অস্ত্র তৈরি হয়েছে। ১ মেগাটন হল ১০ লক্ষ টন বিস্ফোরক টি.এন.টি.-র সমান। এদিকে ৫০ এবং এমনকি ১০০ মেগাটন অবদি শক্তি বিশিষ্ট পারমাণবিক অস্ত্র এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ,হিরোসিমার বোমাটির চেয়ে কয়েক হাজার গুণ শক্তিশালী মারণাস্ত্র এরই মধ্যে গড়ে ফেলেছে উৎসাহীরা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তা দেখে মনে হয়, এ হেন বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে কোনো দেশকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে মহাশ্মশানে পরিণত করা কঠিন নয় মোটেই।

মহাকাশ- বিজয়ের দিক

বিজ্ঞানের গতি প্রকৃতির এই গেল একটি ধ্বংসাত্মক দিক। অন্য একটি উল্লেখযোগ্য সৃজনাত্মক দিক মহাকাশ- বিজয়। রহস্যময় মহাকাশের বুকে পাড়ি দিয়ে মানুষ এরই মধ্যে অনেক অসাধ্য সাধন করেছে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ কে অতিক্রম করে সে চাঁদে পাড়ি দিয়েছে। বিভিন্ন গ্রহে রকেট পাঠিয়েছে। কিন্তু তাই বলে এত অপব্যয়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে মানুষ পাঠাবে বলে অ্যাপোলো প্রজেক্ট -এর জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করেছিল,আমাদের ভারতীয় টাকার হিসাবে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২ হাজার কোটি। তাই কেউ কেউ বলেছেন, ঘরে রুগণ ও বুভুক্ষ মানুষ রেখে কাশ্মীর বা দার্জিলিংয়ের হাওয়া খেতে যাওয়া যেমন অশোভন, পৃথিবীর কোটি কোটি দুঃস্থ মানুষের কথা চিন্তা না করে হাওয়া হীন চাঁদে মানুষ পাঠানো ও ঠিক তেমনি অশোভন।

যন্ত্র- সভ্যতা ও কৃত্রিমতা

এই গেল বিজ্ঞানের গতি প্রকৃতির দু-একটি দিক।এছাড়া, বিজ্ঞান থেকে আজ আমরা যা পাচ্ছি তা নিয়েও অনেকের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। যন্ত্র সভ্যতা ক্রমেই আমাদের কৃত্রিম করে তুলছে। অবিশ্বাস, হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা ক্রমেই ঘিরে ফেলছে আমাদের। ফলে জীবনের সৌন্দর্য ও ভালোবাসার স্থান দখল করছে দ্বেষ-হিংসা ও বিলাস- বিভ্রম। এই বিকৃতি থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজে না পেয়ে অনেকেই আজ যন্ত্র কে দোষারোপ করছেন। বলছেন, বিজ্ঞানবিদ‍্যার অভিশাপ এই যন্ত্র।

উপসংহার

কিন্তু একটু তলিয়ে দেখেলেই বোঝা যায় এজন্যে বিজ্ঞান বিদ্যা বা যন্ত্র দায়ী নয় দায়ী আমাদের লোভ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “আমরা আমাদের লোভের জন্য যন্ত্র কে দোষ দিই, মাতলামির জন্য শাস্তি দিই তালগাছকে।” মনে হয়, এই লোভ ও বিকৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে সহজ সুখের ও সরল সৌন্দর্যের দ্বারস্থ হতে হবে। সেই সুখ ও সৌন্দর্য রয়েছে প্রীতি ও ভালোবাসার মধ্যে, মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে, পৃথিবীর সকল মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের মধ্যে। অতএব, আজ বিজ্ঞান যদি অভিশাপ হয়ে আমাদের সামনে দেখা দেয় তো সেজন্য বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানী দায়ী নয়, দায়ী আমরা। আমরা ভুলতে বসেছি যে, বিজ্ঞানীর ধর্ম নিষ্কাম ধর্ম, বিজ্ঞানের সাধনা সর্ব- মানুষের কল্যাণ সাধনা। বিজ্ঞানের শক্তিকে আজ আমরা যদি সুপথে পরিচালিত করি, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অস্ত্র না গড়ে পারমাণবিক শক্তি কে যদি গঠনমূলক কাজে প্রয়োগ করি, তবে পৃথিবীর অশেষ কল্যাণ হতে পারে, শুধুমাত্র নিজেদের প্রয়োগ কর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গির দোষে যে বিজ্ঞানকে অভিশাপ ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছি, অচিরকালের মধ্যে তা আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Scroll to Top